Saturday, October 19, 2019

চমেকের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে টাকা, লিফটে টাকা,ওয়ার্ডে ঢুকতে টাকা

                                                       চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল


চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটে রিতা বেগম নামে এক রোগীর স্বজন আক্ষেপ করে করে বলেন, ‘এখানে এসেছি বোনের অপারেশন করাতে। সরকারি হাসপাতাল হলেও এখানে কিছুই আমাদের সাধ্যের মধ্যে নেই। হাসপাতালের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত টাকা আর টাকা। ভোগান্তি আর অপমান তো আছেই।’


কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক বকশিস নেওয়া, বেপরোয়া আচরণে অতিষ্ঠ রোগী ও স্বজনরা। রোগীর স্বজনসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে নানা অজুহাতে নেন বকশিস। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে টাকা, লিফ্ট ব্যবহারে টাকা, ওয়ার্ডে ঢুকতে বা ট্রলিতে প্রত্যেকটি স্থানে নির্দিষ্ট বকশিস দিয়েই পরবর্তী ধাপে যেতে হয়। এছাড়াও কারণে-অকারণে হেনস্তার শিকার হন রোগী ও স্বজনরা।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ও স্বজনদের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, এই হাসপাতালের প্রতি ইঞ্চি পেরোতে টাকা দিতে হয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আনসারকে, লিফট ব্যবহারে, ওয়ার্ডে ঢুকতে, ট্রলিতে বা হুইল চেয়ারে করে রোগী আনা নেওয়া করতে বহনকারীকে, আয়াদের সাহায্য নিলে, রোগী কেমন আছেন একটু দেখার অনুরোধ করলে নার্সকে টাকা দিতে হয়। বকশিস দিয়ে হাসপাতাল কর্মচারীদের খুশি করতে পারলেই তড়িঘড়ি করে সেবা পাওয়া যায়। নয়তো তাদের ঝাড়ি খেতে হয়।’
‘হঠাৎ রোগীকে ওষুধ বা ইনজেকশন কিনতে বাইরে যাওয়ার পর ওই ওষুধ বা ইনজেকশন নিয়ে ওয়ার্ডে ঢুকতে বা গেটে বাধা দিল আনসার বা দারোয়ান। টাকা দিলে প্রবেশ অথবা প্রবেশ নিষিদ্ধ’— অভিযোগের সুরে বলেন এক রোগীর স্বজন।

সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিযোগ, বিকেলে ওয়ার্ডের প্রবেশপথে দারোয়ান থাকে না। গেট থাকে তালাবদ্ধ। দারোয়ানের দেখা নেই। ভিতরে করতে প্রবেশ করতে না পেরে স্বজনরা রোগীর অবস্থা জানতে উদ্বেগে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হাসপাতাল কর্মচারীও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আগে এমন অবস্থা ছিল যখন অবৈতনিক কর্মচারীরা কাজ করতো। তখন তাদের বেতন চলতো রোগীর স্বজনদের পকেট থেকে। কিন্তু এরপর নানা অভিযোগের কারণে তাদের হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারিভাবে জনবল নিয়োগ দেয়। কিন্তু তাতেও আগের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের নিয়মেই চলছে টাকার খেলা।

আশিক কুমার নাথ নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘আমার চাচা একজন প্যারালাইজড রোগী। রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য হুইল চেয়ারের প্রয়োজন। কিন্তু ১০০ টাকা না দিলে হুইল চেয়ার পাওয়া যাবে না। ওই আয়াগুলোর দখলে ছিল হুইল চেয়ার। লিফট ব্যবহার করতে গেলে লিফটম্যানকেও টাকা দিতে হল ৫০ টাকা। বুঝতে পারছি না এটা সরকারি হাসপাতাল তো?’

তিনি আরও বলেন, ‘ওয়ার্ডে নার্সদের কথা কী বলবো। রোগী নিয়ে তাদের অবহেলা সহ্য করা যায় না। রোগীর অবস্থা গুরুতর হলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই। নার্সদের কয়েকবার ডাকতে যাওয়ার পরও তাদের সময় হয় না রোগীকে দেখে যাওয়ার। বরং উল্টো বকাঝকা করে। কারণ আমরা সাধারণ মানুষগুলো তাদের কাছে অনেকটাই জিম্মি। ভিজিটিং আওয়ারে রোগী দেখতে আসলেও আনসারকে টাকা দিয়ে ঢুকতে হয়। জনপ্রতি ২০-৩০ টাকা দিতেই হয়। তাদের ব্যবহারও খুব খারাপ। এমনও হয়েছে যে প্রথমে ভেতরেই ছিলাম, চাচার জন্য জরুরি ওষুধ লাগছে, কিন্তু ওই ওষুধ নিয়ে ঢুকতে পুনরায় বাধা। টাকা ছাড়া কেনোমতেই ঢুকতে দেবে না। বাধ্য হয়ে টাকা দিতে হয়।’

গাইনি বিভাগের বাইরে অবস্থানরত মো.আনিসুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসা এমন একটা বিষয় যা কেবল ডাক্তার, যন্ত্রপাতি, নার্স কিংবা মেডিকেল স্টাফ থাকলেই হয় না। চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই হল রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য আন্তরিক মনোভাব। রোগীদের প্রতি কোনো আন্তরিকতা চট্টগ্রাম সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খুঁজে পাবেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে এখানে ভর্তি করানোর পর থেকেই আজ ৫ দিন হলো। আমি দেখলাম টাকা ছাড়া এখানে কিছু চলে না। রোগী মরে গেলেও তাদের কোনো সমস্যা নেই। আপনি টাকা দিয়েই তাদের সেবা পাবেন। নার্সরা চলে তাদের মনের মতো। কোন দায়বদ্ধতা নেই। ১২ অক্টোবর সকালে আমার স্ত্রী সিজারে এক ছেলে সন্তান প্রসব করে। রাতের দিকে আমার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে আমি নার্সদের ডাকতে যাই। তখন তারা আমাকে উত্তর দেয়, আপনি যান, এখান থেকে সময় হলে আমরা আসবো। সারাক্ষণ আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বসে থাকার সময় নেই আমাদের। সারাক্ষণ পাই খারাপ ব্যবহার।’

গাইনি বিভাগের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রবেশদ্বারে নেই দারোয়ান। আয়েশা বেগম গেইট ধরে দাঁড়িয়ে ছটফট করছিলেন। তার মুখে কষ্টের ছায়া। এভাবে ছটফট করছেন কেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গতকাল আমার বোনের সিজারে ডেলিভারি হয়েছে। মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছে। এরপর তাকে এই ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। দুপুরে একটু বাসায় গিয়েছিলাম। এখন তার সাথে ভিতরে কেউ নেই। কিন্তু দারোয়ান না থাকায় ভেতরে ঢুকতে পারছি না। জানি না আমার বোন এখন কোন অবস্থায় আছে। দারোয়ান থাকলে অন্তত ১০-২০ টাকা দিয়ে হলেও ঢুকে যেতাম। কিন্তু এখন সে উপায়ও নেই। এক ঘণ্টারও বেশি হয়ে গেলো দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু দারোয়ান না থাকায় ঢুকতে পারছি না।’

সোমবার (১৪ অক্টোবর) শিশু বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের অনেকেই হাসপাতাল কর্মীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘হাসপাতালের স্টাফগুলোর মধ্যে কোনো দয়ামায়া নেই। তারা তাদের ব্যবসা নিয়ে আছে। খুব খারাপ লাগে বাচ্চার জন্য ওষুধ, ফলমূল নিয়ে আসছি কিন্তু টাকার বিনিময়ে ভিতরে ঢুকতে পারবো। অনেক সময় ভিজিটিং আওয়ারে রোগীর অনেক আত্মীয়-স্বজনরা আসেন দেখতে, তখনও তাদের টাকা দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়।’

বার্ন ইউনিটের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে ছিলেন সিমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার বোন আমার মামাকে দেখতে এলাম। কিন্তু গেটে অবস্থানরত দারোয়ান কোনোভাবে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। তার দাবি জনপ্রতি ২০ টাকা করে তাকে দিতে হবে তাহলেই ঢোকা যাবে। কী আর করবো ২০ টাকা দিয়ে আমি ঢুকেছি। কিন্তু আমার বোনকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কী বলবো, ঢুকতে না দেওয়া যদি কোনো সিস্টেম হতো তাহলে অবশ্যই মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু এটাকে সিস্টেম বানানো হয়েছে শুধুমাত্র রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য।’

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে বর্তমানে ১০০ জন আনসার কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন মহিলা। প্রশাসন বিভাগে আছেন ৩ জন, নতুন বিল্ডিংয়ের নিচে ৩ জন, কলেজে মহিলা আনসার ৩ জনসহ মোট ৪ জন, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ জন, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ জন, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ জন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ জন, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ জন, ক্যাজুলিটি বিভাগে ৩ জন, কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগে ৩ জন, পশ্চিম সিঁড়িতে ৩ জন, মাঝের সিঁড়িতে ৫ জন, পূর্ব সিড়িতে ৫জন, গাইনি বিভাগে ১ জন, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১জন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ১জন, বঙ্গবন্ধু বিভাগে ২জন, কার্পিট বিভাগে ৩ জন, অস্ত্রাগারে ৩ জন, রান্নার ঘরের দায়িত্বে ৩ জন, ফেন্সিল্যাসে ১ জন,২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ২ জন, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ২জন, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১জন, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ২জন, টহলে ৩ জন, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৩জন, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ জন। কমাণ্ডার আছেন ৪ জন,কান্তা ক্লাবে ১জন, ইমারজেন্সিতে ১জন এবং ছুটিতে থাকে ২০জন।

জানা যায়, আনসারদের জনপ্রতি মাসিক বেতন ১৩ হাজার ৫০টাকা। তাছাড়া সরকার থেকে তারা প্রতি মাসে রেশন হিসেবে ২৮ কেজি চাল, ২৮ কেজি গম, ২ লিটার তেল পায়। তাদের বসবাসের জন্য আছে সরকারি কোয়ার্টার। এছাড়া একজন আনসার বছরে ৫০ দিন ছুটি পায়। এতো সুবিধা পাওয়ার পরও তাদের এই বকশিস বাণিজ্য যেন থামেই না। প্রতিদিনই চলে রোগীর স্বজনদের হেনস্তা করার কৌশল।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে হাসপাতালের কিছু আনসার ও স্টাফদের সাথে কথা বললে তারা কথা না বলে সরে পড়ে। তবে হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা কখনও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা চান না। ওনারা খুশি হয়ে আমাদের যা দিয়ে থাকেন আমরা তাই হাত পেতে নেই। চা বিস্কুট খাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে কেউ কেউ নিজের ইচ্ছেতেই আমাদের হাতে ৫-১০ টাকা দেয় সেটাই আমরা নিই।’

এত সুবিধা পাওয়ার পরও আনসার ও অন্যান্য কর্মীরা রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে কেন টাকা দাবি করে জানতে চাইলে আনসার কমান্ডার দেলোয়ার হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এরকম অভিযোগ আগে পেয়েছিলাম এবং এর যথাযথ ব্যবস্থাও নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আমার জানামতে এখন এমন হয় না। তারপরেও যদি হয়ে থাকে এবং উপযুক্ত প্রমাণ থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা এর আগেও অনেক ব্যবস্থা নিয়েছি। রোগীর স্বজনরা হাসপাতালে স্টাফ বা কর্মচারীদের টাকা দিতে বাধ্য নয়, কিন্তু তারাই টাকা দিয়ে দিয়ে স্টাফদের অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে। কে কোথায় টাকা নিচ্ছে সে বিষয়ে আমরা অবগত নই। কিন্তু রোগীপক্ষ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সরাসরি অভিযোগ করলে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: