Monday, August 26, 2019

জন্মাষ্টমীর সংখ্যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর প্রাসঙ্গিক তাৎপর্য্য অধ্যক্ষ মিলন চন্দ্র দেবনাথ

Image result for শ্রীকৃষ্ণের ছবি hd

 দ্বাপরযুগে রাজতন্ত্র এই উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল। এতে অনেক রাজাদের বসবাস ছিল, দ্বাপরযুগের শেষ দিকে রাজায় রাজায় যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকতো। তাদের বিপুল সুশিক্ষিত সৈন্যদল পোষন, তাদের বেতন রসদ প্রজাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করে সংগ্রহ করা হতো। এক রাজা অন্য রাজ্য আক্রমন করে দখল করে নিতেন এবং করদ রাজ্যরূপে অধীন করে রাখতো। তখন চলতো নিপিড়ন-ধর্ষণ-ত্রাস-সন্ত্রাস-লুন্ঠন- অপহরণ- হত্যা প্রতিদিনের ইতিহাস হয়ে উঠলো। এই উপমহাদেশের স¤্রাট প্রবল পরাক্রান্ত মগধরাজ জরাসন্ধ, যার সেনার পরিমান ছিল বিশ অক্ষৌহিনী। (২০ অক্ষৌহিনী=২২,৮৭,০০০ সেনা, ১৩,১২,২০০ ঘোড়া, ৪,৩৭,৪০০ হাতি, ৪,৩৭,৪০০ রথ) তিনি অনেক রাজ্য জয় করে ৮৬জন রাজাকে ধৃত করে কারাগারে রেখেছেন এবং আরো ১৪জনকে ধৃত করে মোট ১০০জন রাজাকে বলি দিয়ে পাশবিক এক যজ্ঞ করার সংকল্প করেন। অপর দিকে পরাক্রমশালী মুথুরার রাজা ছিলেন রাজা উগ্রসেন। তাঁর রাজত্বকালে মথুরা ছিলো মনোহর, সমৃদ্ধিশালী নগরী। তাঁরই পুত্র অনাচারী কংস পিতাকে কারাগারে আবদ্ধ করে রেখে নিজে রাজা হয়ে যান। অন্ধকার যুগ এই উপমহাদেশে শুরু হয়ে গেল।রাজাকংসের ভগ্নিপতি বসুদেব ও দৈবকীকে কারাগারে অবরুদ্ধ করে রাখা হলো, মানবতা হলো ভূলুনন্টিত।এমনি সময়ে আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বৎসর পূর্বে ভাদ্রমাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথির রোহিনী নক্ষত্র যোগে গভীর রজনীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাজা কংসের কারাগারে আবিরর্ভূত হলেন, পিতা বসুদেব, মাতা দৈবকী। শ্রীমদ্ভাগবতে ১০/৩/৯-১০,৩০ শ্লোকে বলা হয়েছে যে, তিনি চতুর্ভূজ রূপে আবির্ভাব রূপে বসুদেব ও দৈবকীকে দর্শনপ্রদান করেনএবং মা দৈবকীর প্রার্থনায় উক্ত রূপ সংবরণ করেন। ঈশ্বর একমাত্র পরম কৃষ্ণ, তিনি সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ অর্ন্তযামীভগবান। তিনি সর্বজীবের প্রভু, অনাদির আদি গোবিন্দ, সর্ব কারণের কারণ স্বরূপ। তাই তিনি কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম। যিনি অব্যক্ত, অচিন্তনীয়, জন্মরহিত, অভিনশ্বর, বর্ণনার অতীত, সর্বভূতের ঈশ্বর, অপ্রপঞ্চ থেকে প্রপঞ্চে, জন্মহীনের জন্ম, ভূমা নেমেছে ধূলার ধরণীতে স্বরূপ প্রকাশে। ঈশ্বর এসেছেন নশ্বর জগতে। ব্রজেন্দ্র নন্দন শ্রীকৃষ্ণের অবতার ছয় প্রকার পুরুষোবতার, গুণাবতার, শক্ত্যাবেশ অবতার ও লীলা অবতার। তাই তিনি হলেন অবতারী সকল অবতারের উৎস।অবতার প্রসঙ্গে সনাতন শিক্ষায় শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু উল্লেখ করেছেন, সৃষ্টি হেতু সেই মূর্তি প্রপঞ্চে অবতরে। সেই ঈশ্বরমূর্তি ‘অবতার’ নাম ধরে∥ মায়াতীত পরব্যোমে সবার অবস্থান। বিশ্বে অবতরি ধরে ‘অবতার’ নাম∥
লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেক দ্বাপর যুগে অবতীর্ণ হন না। তিনি আসেন দ্বাপর যুগের শেষের দিকে, তা আবার প্রত্যেক দ্বাপর যুগে নয়। লোকপতি ব্র‏হ্মার দিবসের মধ্যে একবার মাত্র।এক হাজার চর্তুযুগে ব্র‏হ্মার একদিন, এক হাজার চর্তুযুগে ব্র‏হ্মার এক রাত্র হয়।ব্র‏হ্মার দিন ও রাত্রি দুই হাজার চর্তুযুগের অন্তর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই ধরা ধামে অবতীর্ণ হন। শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃতের ভাষায়, পূর্ণ ভগবান কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্র কুমার। গোলোকে ব্রজের সহ নিত্য বিহার∥ ব্র‏হ্মার একদিনে তিহোঁ একবার। অবতীর্ন হঞা করেন প্রকট বিহার∥ সত্য ত্রেতা-দ্বাপর কলি, চারিযুগ জানি। সেই চারিযুগে দিব্য একযুগ মানি∥ একাত্তর চর্তুযুগে এক মন্বন্তর। চৌদ্দ মন্বন্তর ব্র‏হ্মার দিবস ভিতর∥ ‘বৈবস্বত’ নাম এই সপ্তম মন্বন্তর। সাতাইশ চর্তুযুগ গেলে তাহার অন্তর∥ অষ্টাবিংশ চর্তুযুগে দ্বাপরের শেষে। ব্রজের সহিতে হয় কষ্ণের প্রকাশে∥ (শ্রীশ্রী চৈ.চ আদি৩/৫-১০) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবতার তত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন, ‘‘ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে, মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে। ওরে তুই ওঠ আজি, আগুন লেগেছে কোথা। কার শংঙ্খ উঠেছে বাজি জাগাতে জগৎ জনে।। এই জগতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আর্বিভাবের তিনটি কারণের কথা তিনি নিজে স্বীকার করেছেন। সাধুদের রক্ষা, অসাধুদের বিনাশ ও ধর্মের পুর্নজাগরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা।শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন, পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। ধর্ম সংস্থাপর্নাথায় সম্ভবামি যুগে যুগে∥গীতা-৪/৮

পুরাণাদিতে দেখা যায় কৃষ্ণ অবতারের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে রিভিন্ন রূপ-মত প্রকাশ করেছেন। ভাগবতে বলা হয়েছে ‘‘জন্মরহিত ভগবানের জন্ম উৎপথগামীদের বিনাশের জন্য, কর্মরহিত ভগবানের কর্ম জীব সকলের কর্মে প্রবৃত্তি জন্মাইবার জন্য’’ (ভাগবত ৩/১/৪৩)। গৌড়ীয় গোস্বামীপাদগণ তাঁকে রসময় প্রেমময় ব্রজেন্দ্র নন্দন রূপেই চিন্তা করেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত করেছেন‘‘ প্রেমরস আস্বাদন, ব্রজের নির্মল রাগ, গোপীভাব জীবকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে তাঁর অবতার’’। স্থুল কথায় লোক রক্ষা ও লোক শিক্ষা, এর উভয়ই তাঁর অবতারের উদ্দেশ্য। সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় তার কৃষ্ণ চরিত্র কাব্যয় লিখেছেন‘‘ সকল আদর্শের উপর হিন্দুর আর এক আদর্শ আছে, যার কাছে আর সকল আদর্শ খাটো হয়ে যায়, যুধিষ্ঠির যাঁর কাছে ধর্ম শিক্ষা করেন, স্বয়ং অর্জুন যাঁর শিষ্য, রাম ও লক্ষণ যাঁর অংশ মাত্র, যাঁর তুল্য মহামহিমাময় চরিত্র কখন মনুষ্যভাষায় কীর্ত্তিত হয় নাই, তিনি হলেন শ্রীকৃষ্ণ’’। কেবল একটা কংস বা শিশুপাল মারিবার জন্য যে স্বয়ং ঈশ্বরকে ভূতলে মানব রূপে জন্মগ্রহন করিতে হইবে ইহা অসম্ভব কথা বটে।যিনি অনন্ত শক্তিমান তাহার কাছে কংস শিশুপাল ও যে এক ক্ষুদ্র পতঙ্গ সে। বাস্তবিক যাহারা হিন্দু ধর্মের প্রকৃত মর্মগ্রহন করিতে না পারে তাঁহারাই মনে করে যে অবতারের উদ্দেশ্য দৈত্যবা দূরাত্মা বিশেষের নিধন, আসল কথা, ‘‘ ধর্ম সংরক্ষনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপকে দু’টো ভাগে ভাগ করা যায়। একটি আবৃত, অপরটি হলো প্রকট। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই জগতের লীলা বিলাস গুলোকে নিত্যলীলা বলা হয়। কারণ এই লীলাগুলো জড় জগতের প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা বিলাস সমূহ স্বইচ্ছায় কোন ব্র‏হ্মান্ডে প্রকটিত হয়। আবার কোন ব্র‏হ্মান্ডে অপ্রকটিত থাকে। যেমন বর্তমান শ্রীকৃষ্ণের লীলা সংবরণ করেছেন বিধায় এই ব্র‏হ্মান্ডে প্রকটিত নেই। জীবকুলকে অনুগ্রহ করার জন্য তিনি মনুষ্যদেহ ধারণ করেন এবং মানুষের মতো লীলা করেন। যাঁর মধ্যে নেই কোন কাম ভাব অথচ তিনি মানুষরূপে অবতার। এই জন্য তাঁর লীলাগুলো শ্রবণ করলে মানুষ ভগবদ পরায়ন হবেন। শ্রীমদ্ভাগবত মহাগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘‘অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষং দেহমাশ্রিত:। ভজতে তাদৃশী: ক্রীড়া যা: শ্রুত্বা তৎপরো ভবেৎ’’ (ভা:১০/৩৩/৩৭) এই লীলা অনুসরণ করে ভান্ডারীগানের কিংম্বদন্তি কবিয়ালরমেশ শীল মনের চিদানন্দে গেয়েছেন, অনন্ত ব্র‏হ্মান্ডে তুমি লীলা কর বিশ্বময়। অনাদি অব্যক্ত, তুমি গুণাতীত দয়াময়∥ ব্র‏হ্মান্ডে জুড়িয়া তুমি তুমি পূর্ণ সনাতন। তুমি বিনে ত্রিভুবনে দেখিনা আর অন্যজন∥

পবিত্র গীতার ৭/২৫ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,‘‘ তিনি যে লীলা বিলাস করেন তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। তিনি বলেছেন আমি মূঢ় ও নির্বোধদের কাছে কখনো প্রকাশিত হইনা। তাদের নিকট আমি যোগমায়দ্বারা আবৃত রয়েছি বলেই তারা আমার প্রকৃত ভাব জানতে পারেনা।নিরাকারে শ্রীকৃষ্ণ পরব্র‏হ্ম, জীবের পরমাত্মা এবং জীবের পরমগতি, আবার তিনি সাকারে স্বয়ং ভগবান। তিনি দরিদ্রের বন্ধু বলে দীনবন্ধু, নরের অয়ন বলে নারায়ণ লালন পালন করে বলে তিনি বিষ্ণু। ভক্তের অদীন বলে তিনি ভক্তের ভগবান। তাই পরম ভক্ত বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের আধার বসুদেব ও দৈবকীর হৃদয়ে আজকের তারিখে প্রকাশিত হলেন এবং পিতা মাতা রূপে তাঁদের গ্রহণ করে ছিলেন। জন্ম নিলেন চর্তুভূজ রূপে, মায়ের প্রার্থনায় তিনি দ্বিভূজ রূপ দ্বারন করেন। ভক্ত বাঞ্চা পালন করার জন্য যশোদার গৃহে প্রতিপালন হয়েছিল। তাঁর ১২৫ বৎসর ব্যাপি সমস্ত লীলায় কর্মময় জীবনে ভক্তের জয়গান করা হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সার্বিক তথ্যসমূহ শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, ব্র‏হ্মবৈবর্তপুরাণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভগবদ গীতা, পদ্মপুরাণ, বায়ুপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বামনপুরাণ, কুর্ম্মপুরাণ, গড়–রপুরাণ, দেবীভাগবতম, হরিবংশ, শ্রীশ্রী চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ ইত্যাদি মহাপুরাণ গুলোতে তুলে ধরা হয়েছে। জন্মষ্টমীর অমোঘ আহবান আমাদের নিকট শান্তির বারতানিয়ে আসেন। শিষ্টজন রক্ষার এদিনটির তাৎপর্য অপরিসীম। কলুষতা বর্জিত, হানাহানি মুক্ত নির্লোভ বীর্যময় মহা জীবন গঠনের শুভ সংবাদ নিয়ে জন্মাষ্টমী আমাদের দ্বারে উপস্থিত। আমাদের মননে, চিন্তায়, এ দিনটিকে যত সার্তকভাবে গ্রহণ করা যাবে এবং তাঁর মুখনিঃসৃত বানী শ্রীমদ্ভগবদ গীতার অমৃত রস যত হৃদয়ে ধারণ করা যাবে তত মানবীয়, ধর্মীয় নীতিবোধে পরিপূর্ণ মানব জীবন গঠন করা সম্ভব হবে। সৎ-ন্যায় চরিত্রবান মানবজীবন গঠন এই দিনটির উদাত্ত আহবান।এই দুঃখ দুর্দশাগ্রস্থ পৃথিবীতে আমরা প্রতিদিন নিগৃহীত-নিপীড়িত হে ভগবান। যেখানে ধর্ষণ ত্রাস-সন্ত্রাস-লুন্ঠন-অপহরন-হত্যা প্রতিদিনের ইতিহাস হয়ে উঠেছে। সেখানে চারদিকে বেদনা-যন্ত্রনা-অসত্য-অন্যায়-দৈত্যর মতো সর্বগ্রাসী অবস্থান, দীন-দরিদ্র-বুভুক্ষু-নিঃসহায়ের আর্তি আর আহাকারে আকাশ বাতাস পূর্ণ। হে ভগবান পরমদেবতা, তুমি আবার এসো,‘‘আবির্ভূত’’ হোও। দুঃখ-দুর্দশা- অত্যাচার-বিশ্বেরদুঃশাসন থেকে মানবজাতীকে রক্ষা করো। আজ জন্মাষ্টমী দিবসে বিশ্বের শান্তি ও সমবৃদ্ধি কামনায় কবি কন্ঠে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাই, ‘‘নতুন তব জনম লাগি কাতর যত প্রাণী করো ত্রাণ মহাপ্রাণ আনো অমৃত বানী∥ শুভ জন্মাষ্টমী 

 লেখকঃ অধ্যক্ষ মিলন চন্দ্র দেবনাথ ,ধর্মতত্ত্ববিদ, প্রাবন্ধিক, অধ্যক্ষ- হাটহাজারী রুদ্ররাজ সংস্কৃত কলেজ। বক্তা সনাতন টিভি মোবাইলঃ ০১৭৩১-১২৭০৯২

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: