Wednesday, July 24, 2019

শত ঝড়ঝাপ্টাতেও এগিয়ে যেতে হবে

শত ঝড়ঝাপ্টাতেও এগিয়ে যেতে হবে
 গোলাম মোস্তফা

খাদ্যে ভেজাল নিয়ে অনেক দিন ধরেই দেশ বেশ সরগরম। ভোগ্যপণ্যে ভেজাল দেশে চরম আকার ধারণ করেছে। শুধু ভোগ্যপণ্যই নয়; শিশুখাদ্য, প্রসাধনসামগ্রী, এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও আজ ভেজাল। ভেজাল আর বিষ গ্রহণের ফলে আমরা প্রতিনিয়ত নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছি। ক্যান্সার, লিভার, কিডনি রোগ এবং রক্তশূন্যতা ইত্যাদি নানা রোগের প্রকোপ বেড়েই চলছে। প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তথ্যটি জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের।

ভেজালের কারণে সম্প্রতি হাইকোর্ট ৫২টি পণ্য বাজার থেকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। মানোত্তীর্ণ না হলে এসব পণ্য বাজারজাতকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়। হাইকোর্টের আদেশ-নির্দেশের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক দুধ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দুধে অ্যান্টিবায়োটিক-সমৃদ্ধ ডিটারজেন্ট পাওয়ার কথা দেশবাসীকে অবগত করেন। ব্র্যান্ডগুলো আমার-আপনার সবার চেনা, খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত।

আর যায় কোথায়? এ গবেষণা করার ফলে ওই শিক্ষককে দেখে নেয়ার হুমকি দেন স্বয়ং সরকারের এক সচিব। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য তো এই গবেষণাকে মিথ্যা বলেই চিহ্নিত করেন। তার খুবই কষ্ট লাগে দুধকে নষ্ট বলায়। তিনি এটাকে দুধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে মনে করেন। এ ক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছিউদ্দিনের হুমকিটি ছিল প্রকাশ্য। কোনো স্বীকৃত গবেষণাপত্রে গবেষণাটি প্রকাশ না করে তার তথ্য জনসমক্ষে জানানো এবং দুধ নিয়ে জনমনে সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি করার অপরাধে অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন এই সচিব।




সরকারের এসব দায়িত্বশীল কর্মকর্তার হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও দমেননি অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি দ্বিতীয়বার দুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এবারে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এবারে দশটি নমুনার দশটিতেই অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়! অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, জনস্বার্থে ভবিষ্যতেও এ রকম পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে তিনি পিছপা হবেন না। তিনি আশা করেন, এ গবেষণা দুধ বাজারজাতকরণ কোম্পানিগুলোকে গুণগত মান উন্নত করতে সাহায্য করবে। তিনি সরকারি দায়িত্বশীল সংস্থা দুধে পাওয়া অ্যান্টিবায়োটিক হালকাভাবে না নিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা করারও অনুরোধ করেন। তিনি এও জানান, যদি সমস্যাকে সমাধানের লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়ে তারা কাজ করেন, তা হলে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে এসব গবেষণায় কোনো বিদেশি চক্রান্ত খুঁজতে হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রবীণ শিক্ষক, বায়োমেডিক্যাল রিচার্স সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব এম ফারুক নিতান্তই জাতির বিবেকের তাড়নায় গবেষণাটি সম্পাদন করেছেন বলে স্বীকার করেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির বিবেক হিসেবে জাতির যে কোনো ক্রান্তিকালে জাতিকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

কিন্তু আমরা ভয় করি, যেভাবে নিরীহ একটি গবেষণার ফলকে আক্রমণ করা হয়েছে, প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে- সেটার মাধ্যমে কী উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষের সামনে? এ শিক্ষক হয়তো বিবেকের তাড়নায় জনস্বার্থে ফলাফল প্রকাশ করেছেন। ভয়-হুমকিকে কোনো তোয়াক্কা করেননি তিনি। কিন্তু আমরা কেউই সরাসরি স্বীকার করি বা না করি, আমরা জানি এখনকার শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া কী, তারা গবেষণার চেয়েও কোন কোন জায়গায় আগ্রহী, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের চেয়েও বিভিন্ন রঙের রাজনীতির প্রতি কেন তাদের আগ্রহ- সেই কথাও কারো অজানা নয়। ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যানের স্ট্যান্ড থেকেই তার কিছুটা ধারণা পাই আমরা।

গবেষণার প্রতি আগ্রহের চেয়ে স্রােতের সঙ্গে মিশে বাড়তি সুবিধা আদায় নিয়েই বেশির ভাগের আগ্রহ। এ রকম অবস্থায় একজন শিক্ষক যখন স্রোতের বিপরীতে গবেষণা করেন, জনস্বার্থের কথা ভাবেন- তাকে হুমকি দেয়া, তার গবেষণাকে ঢালাওভাবে প্রত্যাখ্যান করা কেনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তাই অধ্যাপক ফারুকের প্রতি আমাদের সমর্থন প্রকাশ করা উচিত। তাকে এ বার্তাই দেয়া উচিত, জনস্বার্থে যে কাজ যারাই করবেন জনগণ তাদের পাশে অবশ্যই দাঁড়াবে।

------------------------------------------------------------------------

ইতিহাসে আমরা বারবার দেখেছি, সত্য ও যুক্তি প্রচারের কারণে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে হেমলক পানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ধর্মযাজক জওর্দানো ব্রুনোকে প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতার অপরাধে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কোপারনিকাসের তত্ত্বকে স্বীকৃতি দেয়ায় গ্যালিলিওকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তাই জনগণের স্বার্থে শত ঝড়ঝাপ্টাতেও অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের স্বার্থেই তার পিছনে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই।

------------------------------------------------------------------------


দেশের স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমলাদের হেনস্থা করার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। ৭৩০ টাকার পাঞ্জাবি দ্বিগুণ দামে বিক্রির দায়ে রাজধানীর উত্তরায় আড়ংয়ের ফ্ল্যাগশিপ আউটলেট বন্ধ করে দেয়ায় মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারকে রাতের আঁধারে খুলনায় বদলি করা হয়। এটা খুবই লজ্জার ব্যাপার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা বদলি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। এ ধরনের বদলির ফলে যারা সৎ অফিসার, তারা কাজ করতে নিরুৎসাহিত হবেন। বন্ধের মধ্যে বদলির এই আদেশ স্থগিতে প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।

এ দেশের আমলারা সব সময়ই সবার ওপর প্রভাব খাটাতে চান। এ কাজ করতে গিয়ে তারা সংবিধান লঙ্ঘন করতেও দ্বিধাবোধ করেন না, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য মোটেই সমীচীন নয়। জনগণের ঘামের টাকায় দেশ পরিচালিত হয়। তাদের টাকাতেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্য দিয়ে পড়াশোনা করে আমলারা ক্ষমতা পেয়ে থাকেন। তাই জনগণের কল্যাণে তাদের উচিত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা। কিন্তু জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণসাধনের পরিবর্তে তারা জনগণের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে থাকেন। তারা সাধারণ জনগণকে তাদের অধীনস্থ এবং নিজেরা তাদের অভিভাবক হিসেবেই মনে করে থাকেন। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও বহু ভাষণ-বক্তৃতায় বলে গেছেন।

ইতিহাসে আমরা বারবার দেখেছি, সত্য ও যুক্তি প্রচারের কারণে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে হেমলক পানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ধর্মযাজক জওর্দানো ব্রুনোকে প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতার অপরাধে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কোপারনিকাসের তত্ত্বকে স্বীকৃতি দেয়ায় গ্যালিলিওকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তাই জনগণের স্বার্থে শত ঝড়ঝাপ্টাতেও অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের স্বার্থেই তার পিছনে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: